মুমূর্ষু রোগী ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রয়েছেন অ্যাম্বুল্যান্সে, গরমে ছটফট করছে গাড়ির মধ্যে থাকা শিশুরা, এক ফোঁটা জলের খোঁজ করছেন বৃদ্ধ বাসযাত্রী । বৃহস্পতিবার জাতীয় সড়কে ১১ ঘণ্টার অবরোধে এ রকম বহু ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল হাওড়ার ডোমজুড়ের অঙ্কুরহাটি এলাকা। সকাল ১০টা থেকে শুরু হওয়া অবরোধ উঠল রাত ৯টা নাগাদ। যে ৬ নম্বর জাতীয় সড়কে এই অবরোধ হয়েছে, এর প্রভাব তো সেখানে পড়েছেই, কোলাঘাটের দিকে সড়কের প্রায় ২০ কিলোমিটার অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তার প্রভাব দ্বিতীয় হুগলি সেতু ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল কলকাতাতেও।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে এই অবরোধ তোলার জন্য বিকেলে অনুরোধ করেছেন। এদিন সেই বিষয়কে সামনে রেখেই সাংবাদিক বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। সঙ্গে ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বিদ্বেষ ছড়ায় এমন কোনও বক্তব্যকে তিনি সমর্থন করেন না। এ বিষয়ে টুইটে তিনি স্পষ্ট করেছেন নিজের অবস্থানও। তবে একইসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “প্রতিবাদের ভাষা এমন কিছু হওয়া উচিৎ নয়, যাতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। আমরা বাংলায় সব ধর্ম, সব বর্ণ, সব জাতি, সব ভাষার মানুষ একসঙ্গে থাকি। সম্প্রীতি সংহতি এখানে শেষ কথা।”মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, অন্য রাজ্যের কেউ কিছু বললে, কেন বাংলায় রাস্তা অবরোধ হবে? মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “সকাল থেকে হাওড়ার চার পাঁচটা জায়গায় রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে, মানুষগুলোকে ভুগতে হচ্ছে। যাদের আপত্তি আছে, দিল্লি চলে যান। দিল্লি গিয়ে রাস্তা অবরোধ করুন। বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে তো আপনাদের রাগ। বাংলা শান্তির জায়গা, এখানে কেন সেটা করবেন? মানুষ বিরক্ত হচ্ছে, আমাদের গালাগালি শুনতে হচ্ছে।”
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, তিনি সকাল থেকে নবান্নে বসে দেখেছেন রাস্তাঘাটের অবস্থা কতটা শোচনীয়। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, হাজার হাজার গাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তারের গাড়ি, পুলিশের গাড়ি, ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি সমস্ত কিছু রাস্তায় দাঁড়িয়ে। একটা ন্যাশনাল হাইওয়ে আটকে বাংলার মানুষকে সমস্যায় ফেলা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, “আমরা চাই না কোনও ঘটনা ঘটুক। নাখোদা মসজিদের ইমামের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। উনি নিজে বলেছেন, ওনারা এসব পছন্দ করেন না। উনি বলেছেন, রাস্তা অবরোধ না করার জন্য। ফুরফুরা শরিফ থেকেও বলেছে। আমরা বাংলায় রাস্তা অবরোধ করতে দিই না, বনধ করতে দিই না। কেন দিল্লিতে কিছু ঘটলে বাংলায় ঝামেলা করতে হবে? সকলেই আমাদের ভাই বোন। দিল্লির দু’টো বদমাশ কী বলল তার জন্য বাংলায় অবরোধ করার দরকার নেই। যান বিজেপি রাজ্য গুজরাট, উত্তরপ্রদেশে গিয়ে করুন। বাংলায় তো ওরা নেই…মানুষ গাড়ির ভিতর কষ্ট পাচ্ছে, বসে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাদের কী অপরাধ? আমার আবেদন পাবলিককে রেহাই দিন। বাংলায় এসব করতে হবে না।
তার পরেও জট খুলতে রাত ৯টা বেজে গিয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, অবরোধকারীদের বুঝিয়ে রাতে অবরোধ তোলা হয়। অবরোধে অতিষ্ঠ লোকজনেরা দিনভর দোষারোপ করেছেন পুলিশ-প্রশাসনকে। অভিযোগ, পুলিশ এ দিন কার্যত দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল। এ দিন সকাল থেকে গরমের সঙ্গে আপেক্ষিক আর্দ্রতাও ছিল যথেষ্ট। ফলে বেলা যত গড়িয়েছে, ততই অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রয়েছেন অফিসযাত্রী, আনাজ ব্যবসায়ী থেকে ছোট শিশুরা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাস্তার ধারের দোকানগুলিতে রসদে ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে খাওয়াদাওয়া তো দূর, দুপুর থেকেই সঙ্গের শিশুর জন্য এক বোতল জল বা একটি বিস্কুটের খোঁজে গিয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে অনেককে।প্রশ্ন উঠেছে, কী ভাবে শুরু হল এই অবরোধ? কারা অবরোধের পিছনে? পুলিশ প্রশাসন সূত্রের খবর, বিজেপির সাসপেন্ড হওয়া নেত্রী নূপুর শর্মার একটি বক্তব্যের প্রতিবাদে সকাল ১০টা নাগাদ আচমকা কয়েক শো যুবক রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ শুরু করেন কোনো এক্সপ্রেসওয়েতে, যেখানে ৬ নম্বর জাতীয় সড়কে মিশেছে, তার থেকে কোলাঘাটের দিকে ৩ কিলোমিটার দূরের একটি এলাকায়। দ্রুত যানজট ছড়াতে থাকে।অবরোধের এলাকাটি হাওড়া সিটি পুলিশের অধীনে হলেও যানজট ছড়িয়ে পড়ে হাওড়া গ্রামীণ এলাকায়। হাওড়া সিটি পুলিশ ও জেলা পুলিশের মধ্যে দায় ঠেলাঠেলি শুরু হয়।
পরে হাওড়া পুলিশ কমিশনার সি সুধাকর বলেন, ‘‘দুপুর থেকেই অবরোধ তোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু প্রচুর যানবাহন ও যাত্রী রাস্তায় থাকায় সতর্ক ছিলাম। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি যাতে না হয়, সেই কথা মাথায় রেখে পুলিশ জোর করে অবরোধকারীদের সরায়নি।’’ তাঁর দাবি, ‘‘রাত ৮টার পরে গোটা জাতীয় সড়ক থেকে অবরোধ সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’ যদিও আমজনতার বক্তব্য, অবরোধ উঠেছে রাত ৯ টায়।হাওড়ায় গ্রামীণ জেলার ট্র্যাফিক পুলিশ অবশ্য বিকেলের দিকে পাঁচলা ও উলুবেড়িয়া থেকে গাড়িগুলিকে আমতা হয়ে হুগলির দিকে পাঠিয়ে দিতে শুরু করে। হাওড়া গ্রামীণ জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘ঘটনাটি ঘটেছে হাওড়া সদর সিটি পুলিশের এলাকায়। সেই রেশ হাওড়া গ্রামীণ জেলা পুলিশ এলাকায় পড়ে। তখন গাড়িগুলিকে অন্যত্র ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। তাতে যানজট কিছুটা কমে।’’ এক ট্রাকচালক এর মধ্যেই বলেন, ‘‘পুলিশ অন্যত্র গাড়ি ঘুরিয়ে দিচ্ছে, সেটা ভাল কথা। কিন্তু তাতে জ্বালানি বেশি খরচ হচ্ছে। পুলিশ প্রথমেই অবরোধ তুলে দিলে, মানুষকে ভোগান্তির মুখে পড়তে হত না।’’ দূরপাল্লার বাস থেকে নেমে এক দম্পতি ব্যাগ ঝুলিয়ে, শিশুকে কোলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। যাবেন বেহালায়। আবার ঠাকুরপুকুর থেকে বাড়ি ফিরছিলেন এক ক্যানসার রোগী। তাঁর অ্যাম্বুল্যান্স ঠায় দাঁড়িয়ে।
Comentarios